প্রকাশিত: ৩০/১২/২০১৬ ৮:১৯ এএম

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি বরাবর খোলা চিঠি লিখেছেন বিশ্বের ২৩ বিশিষ্ট ব্যক্তি। এদের মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৩ নোবেলজয়ী রয়েছেন। এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ব্যবসায়ী রয়েছেন চিঠিতে স্বাক্ষরকারীর তালিকায়।

আজ বৃহস্পতিবার ঢাকায় ইউনূস সেন্টার থেকে চিঠির বিষয়ে জানানো হয়। চিঠিটি হুবহু তুলে দেওয়া হলো :

প্রিয় নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যবৃন্দ,

আপনারা অবগত আছেন যে, জাতিগত নিধন ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধতুল্য একটি মানবীয় বিপর্যয় মিয়ানমারে বিস্তৃতি লাভ করছে।

গত দুই মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রাখাইন প্রদেশে যে সামরিক আগ্রাসন চালানো হচ্ছে তাতে শত শত রোহিঙ্গা নাগরিক হত্যার শিকার হচ্ছে। ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ এর ফলে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, বেসামরিক মানুষদের নির্বিচারে আটক করা হচ্ছে, শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। আরো ভয়ের ব্যাপার, মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলোকে সেখানে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে, যার ফলে আগে থেকেই চরম দরিদ্র এই এলাকাটিতে মানবীয় সংকট ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। হাজার হাজার মানুষ নিকটবর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে যাচ্ছে যেখান থেকে তাদের ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ঘটনাটিকে গণহত্যাতুল্য বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নিকট অতীতে রুয়ান্ডা, দারফুর, বসনিয়া ও কসোভোয় সংঘটিত গণহত্যাগুলোর সব বৈশিষ্ট্য এখানে দৃশ্যমান।

জাতিসংঘ রিফিউজি হাইকমিশনের বাংলাদেশ কার্যালয় প্রধান জন ম্যাককিসিক মিয়ানমার সরকারকে জাতিগত নিধন পরিচালনার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি রাখাইন রাজ্যে প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে অভিযোগ করেছেন।

রোহিঙ্গারা পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর একটি যারা দশকের পর দশক পরিকল্পিত প্রান্তিকীকরণ ও অমানবিক আচরণের শিকার। ১৯৮২ সালে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয় ও তাদের রাষ্ট্রহীন করে ফেলা হয়, যদিও তারা বংশপরম্পরায় মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে। তাদের চলাচল, বিবাহ, শিক্ষা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। মিয়ানমারের সরকার, সামরিক বাহিনী ও মিয়ানমার সমাজের অনেকেই এই দাবি করেন বটে, কিন্তু বাংলাদেশ তাদের তার দেশের নাগরিক বলে কোনোদিন স্বীকার করেনি।

তাদের দুর্দশা নাটকীয়ভাবে ঘনীভূত হয় ২০১২ সালে যখন দুটি ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনায় লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং পাশাপাশি অবস্থিত মুসলিম ও বৌদ্ধ রাখাইনদের বর্ণবৈষম্যের ভিত্তিতে আলাদা করে ফেলা হয়। এরপর থেকে তারা চরম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করে আসছে।

সর্বশেষ সংকটটির সৃষ্টি হয় ৯ অক্টোবর মিয়ানমার বর্ডার পুলিশের ওপর আক্রমণের একটি ঘটনায়, যাতে মিয়ানমার বর্ডার পুলিশের ৯ জন সদস্য নিহত হন। এই আক্রমণ কারা, কীভাবে ও কেন করলো সে সত্য এখনো উদ্ঘাটিত হয়নি, তবে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপকে এজন্য দায়ী করছে। এই অভিযোগ যদি সত্য হয়েও থাকে, এতে সামরিক বাহিনীর প্রতিক্রিয়া একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। এজন্য সন্দেহভাজনদের আটক, জিজ্ঞাসাবাদ ও বিচারের মুখোমুখি করা এক জিনিস, আর হাজার হাজার নিরীহ বেসামরিক নাগরিকের ওপর হেলিকপ্টার গানশিপ দিয়ে গুলিবর্ষণ করা, নারীদের ধর্ষণ করা এবং শিশুদের আগুনে নিক্ষেপ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে একজন রোহিঙ্গা বলেন, পলায়নরত মানুষদের ওপর তারা গুলিবর্ষণ করে। তারা গ্রামটি ঘিরে ফেলে এবং ঘরে ঘরে তল্লাশি চালাতে শুরু করে। তারা গালিগালাজ করছিল এবং নারীদের ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছিল।

আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী নারী জানান, কীভাবে তাঁর দুই ছেলেকে কোনো কারণ ছাড়াই আটক করা হয় : “তখন সবেমাত্র ভোর হয়েছে। সামরিক লোকজন আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। কয়েকজন ঘরে ঢোকে এবং আমাকে ও আমার সন্তানদের টেনে-হিঁচড়ে বাইরে বের করে আনে। তারা আমার দুই ছেলেকে বেঁধে ফেলে। তাদের পিঠমোড়া করে বাঁধা হয়, এরপর বেধড়ক পেটানো হয়। মিলিটারিরা তাদের বুকে লাথি মারে। আমার সামনেই এটা ঘটে, আমি চিৎকার করে কাঁদতে থাকি। আমি কাঁদতে থাকলে তারা (মিলিটারি) আমার দিকে বন্দুক তাক করে। আমার অন্য সন্তানরা মিলিটারিদের কাছে হাতজোড় করে তাদের না পেটাতে অনুরোধ করে। তাদের নিয়ে যাওয়ার আগে প্রায় ৩০ মিনিট এভাবে মারধর করা হয়।” তিনি তাঁর ছেলেদের এরপর আর দেখেননি।

অং সান সু চির কাছে বারবার আবেদনের পরও তিনি রোহিঙ্গাদের পূর্ণ ও সম-নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় আমরা হতাশ হয়েছি। সু চি মিয়ানমারের নেত্রী এবং দেশটিকে সাহস, মানবিকতা ও সমবেদনার সঙ্গে পরিচালনা করার দায়িত্ব তাঁরই।

মিয়ানমার সরকারকে মানবিক সহায়তার ওপর সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করার জন্য সম্ভাব্য সব উদ্যোগ নিতে আমরা জাতিসংঘের নিকট সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি, যাতে মানুষ জরুরি সহায়তা পেতে পারে। সাংবাদিক ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদেরও সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া উচিত এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে একটি নিরপেক্ষ, আন্তর্জাতিক তদন্ত পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন।

একই সঙ্গে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি জরুরি এজেন্ডা হিসেবে সংকটটিকে উপস্থাপনের জন্য আমরা নিরাপত্তা পরিষদকে বিশেষভাবে আহ্বান জানাচ্ছি এবং জাতিসংঘ মহাসচিবকে জরুরি ভিত্তিতে সামনের সপ্তাহগুলোতে মিয়ানমার পরিদর্শন করতে অনুরোধ করছি। বর্তমান মহাসচিবের পক্ষে এটা সম্ভব হলে আমরা তাঁকেই সেখানে যেতে অনুরোধ করব; অন্যথায় নতুন মহাসচিবকে জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পরই এ বিষয়টিকে তাঁর কর্ম-তালিকায় অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে অনুরোধ জানাব।

আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকেও এখন এ বিষয়ে সম্মিলিতভাবে আরো বেশি সোচ্চার হতে হবে। রুয়ান্ডার পর বিশ্ব নেতারা বলেছিলেন, ‘আর কখনো নয়।‘ আমরা এখনই ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে মানুষ গুলি খেয়ে না মরলেও অনাহারে মারা যাবে এবং আমরা মানবতাবিরোধী এসব অপরাধের নিরব দর্শক হয়ে আরো একবার “আর কখনো নয়” বলার জন্য বিলম্বে হাত কচলাতে থাকবো।

চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা হলেন :

১. প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস

নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০০৬ জয়ী

২. হোসে রামোস-হরতা

নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৯৬ জয়ী

৩. আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু

নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৮৪ জয়ী

৪. মেইরিড মাগুইর

নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৭৬ জয়ী

৫. বেটি উইলিয়াম্স

নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৭৬ জয়ী

৬. অসকার অ্যারিয়াস

নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৮৭ জয়ী

৭. জোডি উইলিয়াম্স

নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৯৭ জয়ী

৮. শিরিন এবাদী

নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০০৩ জয়ী

৯. তাওয়াক্কল কারমান

নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০১১ জয়ী

১০. লেইমাহ বোয়ি

নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০১১ জয়ী

১১. মালালা ইউসুফজাই

নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০১৪ জয়ী

১২. স্যার রিচার্ড জে. রবার্টস

চিকিৎসা শাস্ত্রে ১৯৯৩ সালে নোবেল পুরস্কার জয়ী

১৩. এলিজাবেথ ব্ল্যাকবার্ন

চিকিৎসা শাস্ত্রে ২০০৯ সালে নোবেল পুরস্কার জয়ী

১৪. এমা বোনিনো

ইতালির প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী

১৫. রিচার্ড কার্টিস

এসডিজি সমর্থক, চলচ্চিত্র কাহিনীকার, প্রযোজক ও পরিচালক

১৬. আলা মুরাবিত

এসডিজি সমর্থক, লিবীয় নারী অধিকার প্রবক্তা

১৭. অ্যারিয়ানা হাফিংটন

দ্য হাফিংটন পোস্টের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক

১৮. স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন

ব্যবসায়ী নেতা ও সমাজসেবী

১৯. পল পোলম্যান

ব্যবসায়ী নেতা

২০. মো ইব্রাহীম

উদ্যোক্তা ও সমাজসেবী

২১. জোকেন জাইটজ

ব্যবসায়ী নেতা ও সমাজসেবী

২২. কেরি কেনেডি

মানবাধিকারকর্মী

২৩. রোমানো প্রদি

ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী

পাঠকের মতামত

দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রাখাইন, নতুন আশ্রয়প্রার্থীর আশঙ্কায় বাংলাদেশ

নজিরবিহীন সংকটে পড়তে যাচ্ছে প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় উন্নতির সম্ভাবনা না থাকায় ...